কলকাতা: কেউ এসেছেন নদীয়ার নাকাশিপাড়া থেকে, কেউ বা নৈহাটির৷ কারও বয়স ২৬ তো কারও ৬৬৷ ভিড়ের মধ্যে মহিলাও আছেন৷ আছে গাড়ির মেলাও! ‘কে বা প্রাণ আগে করিবেক দান’-এর মতো ভিড় উপচে পড়ছে তিনতলা ভবনে৷
মনোনয়ন পেশ শুরু হয়ে গিয়েছে চার দিন হল৷ এখনও শেষ মুহূর্তে দলীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অনেকে ভিড় করছেন কলকাতায় ৷ কেউ কেউ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন কালীঘাটে দিদিমণির বাড়ির সামনে তাঁর নজরে পড়তে৷ যদি দলনেত্রী তাঁকে চিনতে পেরে একটু কুশল সংবাদ নেন| তা হলে তো কেল্লা ফতে! যাঁদের সেই সুযোগ হচ্ছে না, পাড়ি দিচ্ছেন রাজ্যের শাসকদলের পার্টি অফিস ‘তৃণমূল ভবনে’৷
গত চারদিন ধরে এমনই হাল কলকাতার ৩৬জি তপসিয়া রোডের তিনতলা ভবনটায়, মানে ‘তৃণমূল ভবনে’৷ হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন৷ এটাই এ চা-সিঙ্গারা বিতরণ থেকে শুরু করে বোতলের পর বোতল জল ভরতে ভরতে তাঁদের নাস্তানাবুদ হাল! এ বারে প্রার্থী বাছাইয়ের চাপটা একটু বেশি? ভিড়ে ভাঙড়ের ডাকাবুকো তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম ৷ তা হলে এ বারে ছেলে-বউমা দু’জনকেই প্রার্থী করছেন? একগাল হেসে তাঁর নির্লিপ্ত জবাব, ‘‘সবই দলের ইচ্ছে৷ আমি বলার কে৷’’
পার্টি অফিসের সর্বক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কালঘাম ছোটার জোগাড়! কেউ এসেছেন নিজের জন্য, কেউ বা স্ত্রী, ছেলে, বউমা কিংবা নিকটাত্মীয়র জন্য৷ কেউ বা এসেছেন স্রেফ অন্যের প্রার্থীপদে ভাঙানি দিতে! আচমকা ভোটের দিন ঘোষণায় বিরোধীরা স্পষ্টতই দিশেহারা৷ তৃণমূল নেত্রী অনেক দিন আগে থেকেই বার বার দলীয় নেতা-কর্মীদের বলছেন পঞ্চায়েত ভোটের জন্য প্রস্তুতি নিতে| কিন্তু টিকিট পাওয়া নিয়েই তো যত ঝামেলা! তিনতলা ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পা রাখতেই ভেসে আসছে হরেক রকম আর্জি৷ কারও আর্জি, ‘‘দাদা, এত বছর ধরে পার্টিটা করছি৷ এ বারও যদি পঞ্চায়েতের টিকিটটা না পাই, তবে কবে পাব!’’
মালদহ থেকে আসা এক জন জানালেন, পঞ্চায়েত ভোটের জন্য সেখানকার জেলা পরিষদের মনোনয়নপত্র আজ থেকে জমা দেওয়ার কাজ শুরুর কথা। ওই জেলা পরিষদের ৩৮ টি আসনের দলীয় প্রার্থী নিয়ে এখনও নাকি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি মালদা জেলা তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। একটি আসনের জন্য একাধিক দাবিদারের নাম উঠে আসায় কার্যত হতভম্ব হয়ে পড়েছেন দলের মালদহ জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন। কারও ধরা গলা ভেসে আসছে, ‘‘দাদা প্লিজ একটু দেখুন৷ নিজের জন্য তো বলছি না, আমার ছেলেটা অনেক আশা নিয়ে বসে আছে৷রবীন্দ্রনাথ ঘোষের ছেলে টিকিট পেয়ে গেল! আমার ছেলে পাবে না?’’
কারও চাহিদা আরও বেশি৷ নিজে দলের স্থানীয় কেউকেটা৷ ইতিমধ্যে ছেলেকে পঞ্চায়েতের প্রধান পদে বসিয়েছেন৷ এ বারের নির্বাচনে ছেলেকে জেলা পরিষদে পাঠিয়ে বউমাকে বসাতে চান পঞ্চায়েতের পদে৷ দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘‘সংসার বড় হয়েছে৷ পরিবারের সদস্যদের চাহিদা তো থাকবেই৷ হচ্ছেও তাই৷ আমরা একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে প্রার্থী বাছাই করছি৷’’ কেমন সেই গাইড লাইন? দলীয় সূত্রের খবর, যাঁরা গতবারে নির্বাচিত হয়েছেন, একান্ত বড় কোনও দুর্নীতির অভিযোগ না থাকলে এ বারও তাঁদের প্রার্থী করা হবে৷ সেক্ষেত্রে সিংহভাগ আসনে অধিকাংশ প্রার্থী এ বারেও পূর্ব নির্ধারিত৷ বাকি যে আসনগুলি রয়েছে, সেখানে জনসংযোগ রয়েছে, এমন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷
সবক্ষেত্রে যে দলের গাইডলাইন ১০০ শতাংশ মানা হচ্ছে না, একান্ত আলাপচারিতায় নেতারা তা অকপটে স্বীকার করেছেন| এক নেতার কথায়, ‘‘সেটা করতে গেলে তো ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে৷ ফলে স্থানীয় নেতাদের চোখ দিয়ে শোনা আর কান দিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই৷ কারণ, হাতে তো সময় খুবই অল্প!’’
গোষ্ঠী কোন্দল এড়াতে বুথ কমিটিকেই মান্যতা দিচ্ছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূল। ব্লক ও বুথস্তরে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তা সত্বেও ওই জেলার অনেকে ভিড় জমিয়েছেন তৃণমূল ভবনে| দক্ষিণ দিনাজপুরে শাসকদলের অভ্যন্তরের গোষ্ঠী কোন্দল বহু দিনের। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার এক বছর পর থেকেই শুরু হয় গোষ্ঠী কোন্দল। একদিকে দলের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্র গোষ্ঠী। আরেক দিকে তপনের বিধায়ক বাচ্চু হাঁসদা, শংকর চক্রবর্তী ও সত্যেন রায়দের গোষ্ঠী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন