আজ বিকেল: বনগাঁ শহরে চলতে থাকা বেআইনিভাবে পুকুর ভরাট আটকাতে অবশেষে তৎপর হল প্রশাসন। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেআইনিভাবে পুকুর ভরাটের কোনও ঘটনা ঘটলে দ্রুত তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷
সম্প্রতি, বনগাঁ মহকুমা শাসকের দফতরে পুরসভার আধিকারিক ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেন মহকুমা শাসক৷ বৈঠকে শহরে বুকে বেআইনিভাবে পুকুর ও জলাশয় ভরাট রুখতে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ যে জলাশয়গুলিতে ছ’মাসের বেশি জল থাকে, সেগুলি ভরাট করা হলে রাজ্য মৎস্য দফতর জমির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলেও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয় বলে সূত্রের খবর৷ কিন্তু, ছ’মাসের কম সময় সে জলাশয়ে জল থাকে, সেগুলি ভটার করার ক্ষেত্রে জমির মালিকের বিরুদ্ধে কে আইনি পদক্ষেপ নেবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলেই সূত্রে খবর৷ তবে, এবিষয়ে পুরসভা নাকি ভূমি এবং ভূমি সংস্কার দফতর আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে৷ যদিও, গত মে মাসে নবান্নের তরফে জেলার সমস্ত প্রশাসনিক দফতরে পুকুর কিম্বা জলাশয় ভরাট রুখতে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ পাঠিয়েছে বলে জানা গিয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়ও রাজ্যের পুকুর ভরাটের সমস্যা নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন৷ প্রশাসনকে কড়া হতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন৷
সীমান্ত শহরে বনগাঁয় পুকুর ভরাট একটি জ্বলন্ত সমস্যা। একশ্রেণির জমি মাফিয়া ও প্রমোটার পুকুর ভরাটে মদতের অভিযোগ আগেই উঠেছে৷ মালিকের কাছে কম দামে জলাশয় কিনে তা ভরাট করে দেওয়া হয়। পরে ওই জমি বাংলাদেশিদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করারও অভিযোগ রয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমি হাঙরদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের যোগাযোগ থাকায় মাফিয়ারা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাজ করে চলেছে। পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকদের সঙ্গেও জমির দালাল ও প্রমোটার চক্রের ওঠাবসার অভিযোগ উঠেছে।
বনগাঁয় বামফ্রন্টের সময় থেকেই পুকুর ভরাটের রীতি শুরু হয়৷ লাল ঝাণ্ডা হাতে বহু কমিউনিস্টকেই জমির দালালিও করতে দেখা গিয়েছিল৷ সেই প্রথা এখনও বর্তমান৷ শুরু রঙ বদলে গিয়েছে বলে অভিযোগ৷ বাম শাসনকালে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে বনগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বহু স্মৃতিবিজড়িত দীঘিটিকে অবৈধভাবে ভরাট করার মধ্য দিয়ে। সাতের দশকেও ওই দীঘিতে সাঁতারের প্রতিযোগিতা হয়েছে, সাতের পল্লীর সরস্বতী পূজা হয়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে বনগাঁ শহরে রাজনৈতিক নেতাদের মদতে একদল মাস্তান ও জমি হাঙররা একের পর এক পুকুর ভরাট করিয়েছে৷ বনগাঁ মহকুমা প্রশাসনের নাকের ডগায় বড় ডাকঘরের পিছনে আমলাপাড়ায় দীর্ঘদিনের 'যম পুকুরের' ৩৬.৯৪ একর জমির শ্রেণি পরিবর্তন না করে মাটি ফেলে বোজানো হয়েছে। যদিও এর বিরুদ্ধে জনৈক হৃষীকেশ সমাদ্দার কলিকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন৷ যার কেস নং:-WP 5944/2016৷ বনগাঁয় গান্ধীপল্লীতে বনগাঁ পুরসভা বাসস্ট্যাণ্ডের জন্য একটি জমি কিনেছে। সেই জমির একটা দাগের শ্রেণি 'পুকুর’ বলে ‘রেকর্ড’ রয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন৷ সেটিও শ্রেণি পরিবর্তন না করে বোজানো হয়েছে বলেও অভিযোগ। এই বিষয়েও হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছে যার কেস নং:-WP 8761/2016৷ এছাড়াও সাম্প্রতিক অতীতে বনগাঁর পূর্বপাড়ায়, বসাকপাড়া-দত্তপাড়ায়, পুরসভার কয়েকপা দূরে খেলাঘর মাঠ সন্নিহিত পুকুর বোজানো হয়েছে বলে অভিযোগ। এই পুকুরগুলি বোজানোয় বনগাঁর জলনিকাশি ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে চলেছে তা পূরণ হবার নয় মনে করছেন পরিবেশ কর্মীরা৷
বনগাঁ শহরের বুকে লাগাতার একাধিক অভিযোগ উঠলেও পুকুর ভরাট নিয়ে বেশ কড়া আইন রয়েছে৷ ১৯৫৫ সালে তৈরি পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইনের ‘৪সি’ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও জমির চরিত্র বদল করা যেতে পারে। তার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাতে হয়। কেউ জলাশয় ভরাট করতে চাইলেও প্রশাসনের কাছে নিয়ম মেনে আবেদন করতে পারে। জেলা স্তরের পরিবেশ সংক্রান্ত এক বিশেষ কমিটি তা খতিয়ে দেখে অনুমোদন দিতে পারে। সেক্ষেত্রে শর্ত হিসাবে ওই জলাশয়ের মালিককে সম পরিমাণ জলাশয় সংশ্লিষ্ট মৌজা বা পাশের মৌজায় খনন করে দিতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বেআইনিভাবে কেউ জলাশয় ভরাট করলে ভূমি সংস্কার আইনের ‘৪ডি’ ধারায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তির তিন বছরের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা এবং উভয় সাজাই হতে পারে। পুলিশও অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারে। মৎস্য দফতরও জলাশয় ভরাট আটকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে প্রশাসনের আধিকারিকরা জানিয়েছেন।
কিন্তু, কড়া আইন থাকলেও কেন এতদিন নেওয়া হল না কোনও ব্যবস্থা? পুকুর ভরাট নিয়ে যখন মুখ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেলন, ঠিক তখনই হঠাৎ কেন তৎপরতা শুরু হল? পুকুর ভরাট করা হলে এফআইআর দায়ের কথা বলা হলেও, গত চার দশকে যে পুকুরগুলি ভরাট করিয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, সেই অভিযোগগুলির কি কোনও ব্যবস্থা আদৌও নেওয়া সম্ভব?প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ বাসিন্দারাই৷
সীমান্ত শহরের হাঁড়ির খবর ~আজ বিকেল ই-পেপার
[left-sidebar]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন