সাধন বিশ্বাস: প্রায় সকল গ্রামীণ ক্ষেত্রেই আজ থেকে দশ-বিশ-ত্রিশ বছর আগেও যে আর্থিক পরিস্থিতি ছিল, সেই নিরিখে বর্তমান সময়ে তার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বলাই বাহুল্য এই পরিবর্তন সদর্থক। অর্থাৎ আর্থিক উন্নতি হয়েছে। তখন হয়তো অনেকের বেশ কয়েক বিঘা জমিজিরেত ছিল, কিন্তু দু'বেলা ঠিক মতো খাওয়া জুটতো না। অভাব ছিল বিস্তর, রোগগ্রস্ততায় চিকিৎসা করাবার মতো সংগতি ছিল না, সম্ভব হত না ভালো কিছু পোশাক পরবার। সেইসব দুরাবস্থার অনেক সমাধান হয়েছে। অনেকগুলো ফ্যাক্টর এই পরিবর্তনের জন্য সহায়ক হয়েছে।
প্রথমত, তখন জমি ছিল বটে, কিন্তু চাষাবাদ করে ফসল ফলানোর প্রতিকূলতা ছিল। প্রতিকূলতার কারণ, সেচব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। পাম্প বা স্যালোমেসিনের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। ফলে তিন-ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। বড় জোর বৃষ্টির ভরসায় একটি মাত্র ফসল ফলতো, তাও শুধু আমন ধান চাষ। সবজির চাষ খুব কম। এখন সেই অভাব না থাকায় জমিতে তিন-চার ফসল চাষ হচ্ছে এবং সেই ফসল সহজেই বাজারজাতকরণের মাধ্যমে সারা বছরই বেশ কিছু আয় আসছে।
দ্বিতীয়ত, তখন শিক্ষা-ব্যবস্থা ছিল দারুণ সংকটজনক, সকলের কাছে শিক্ষা-প্রাপ্তি ছিল অধরা। ফলে অনিবার্যতায় শিক্ষিতের হার, উচ্চশিক্ষিতের হার ছিল ভীষণ কম। যার কারণে নির্ভরযোগ্য কর্মসংস্থান বা চাকরিবাকরি জুটতো না। সামান্য চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে গোটা পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন হতো, তাই অভাব -অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী । ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আর মানুষের শিক্ষার প্রতি গুরুত্বহীনতার ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটার কারণে বহু পরিবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সরকারি-বেসরকারি নানান ক্ষেত্রে কাজে বা চাকরিতে যুক্ত হয়েছে। আর এর কারণে অনিবার্য ভাবে সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।
তৃতীয়ত , গ্রাম্য এলাকায় বহু পরিবারে ভুল ধারণা ছিল চাকরি করা মানে অপরের গোলামি করা! আর পরিবারের ছেলেমেয়েদের বাইরে পাঠানোতে ছিল প্রবল অনীহা। ফলে কোন যুবক যে অন্য রাজ্যে গিয়ে কলকারখানা বা কোন কোম্পানিতে কাজ করবে, তাতেও ছিল প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু বর্তমান সেই মানসিকতার অবসান হবার ফলে বহু যুবক ভিন রাজ্যে গিয়ে নানান কাজ করছে। আবার বহু মানুষ অন্য রাষ্ট্রে গিয়েও নানান কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। আর সংগঠিত শ্রমিকরা বেশ ভালোই মাইনে পায়। এই বহির্মুখীতায় পরিবারের আর্থিক উন্নতির অন্যতম কারণ।
শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির ফলে পরিবারের বহু ছেলেমেয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে । এক সময় বাড়ির যে মেয়ে-বৌরা সংসারে একেবারে পর্দানসীন হয়ে জীবন কাটাতো, তাদেরও আজ সম্মানের উন্নতি হয়েছে। উচ্চশিক্ষান্তে তারাও আজ স্কুলে পড়াচ্ছে, টিউশানি করছে, অঙ্গন ওয়াড়ী শিক্ষিকা বা কর্মী হিসাবে কাজ করছে। বহু 'আশা'- কর্মী নিয়োজিত হয়েছে মেয়েরা ।এছাড়াও তারা আজ নানান কর্মমুখীনতায় নিয়োজিত হয়ে সংসারকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দিচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের সুফলে বহু যুবকরা বিদ্যু-সংক্রান্ত নানান কাজের সুযোগ করে নিয়েছে। এর ফলে সরকারি চাকরির অপ্রতুলতার ঘাটতি হিসাবে খানিকটা বেকার সমস্যার সমাধান হয়েছে। তবু জনসংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধির কারণে বেকাররত্বের জ্বালা রয়েই গেছে।
এত কিছুর পরেও দেশের বা রাজ্যের বহু গ্রামে এখনও আর্থিক সমস্যা বা অভাব প্রকট। এখনও হয়তো বহু সংসারের সদস্যরা দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পায় না, চিকিৎসার সুযোগ পায় না। নষ্ট-স্বাস্থ্যের কঙ্কালসার শিশুরা যখন ক্ষিধেয় ক্রন্দন করে, আর তাদের বাবা -মায়েরা অনটনের হতাশায় হাহাকার করে, তখন ' গ্রামীণ ক্ষেত্রে আর্থিক উন্নতি হয়েছে'---- এ কথা যেন মিথ্যা হয়ে যায়। এই প্রচার যেন বড় ব্যঙ্গ বলে মনে হয়! সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে যখন দেখা যাবে গ্রামীণ এলাকায় সত্যিকারের আর্থিক উন্নয়নের চিত্র ,তখনই আমরা গর্ব করে বলতে পারবো, গ্রাম আজ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে নেই ,নেই অভাব।[left-sidebar]
সীমান্ত শহরের হাঁড়ির খবর ~আজ বিকেল ই-পেপার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন