ত্রিপুরায় নতুন সরকারের কর্মধারার প্রতিফলন রাজ্যপালের ভাষণে - Aaj Bikel
ত্রিপুরায় নতুন সরকারের কর্মধারার প্রতিফলন রাজ্যপালের ভাষণে

ত্রিপুরায় নতুন সরকারের কর্মধারার প্রতিফলন রাজ্যপালের ভাষণে

Share This

আগরতলা   : দ্বাদশ ত্রিপুরা বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে রাজ্যপাল তথাগত রায় রাজ্যে সরকারের কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যখ্যা দিয়েছেন। একেই সঙ্গে আগামী দিনে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি কী হবে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচির প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা গেছে রাজ্যপালের ভাষণে।

বিধানসভায় তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে ভারত সার্বিক প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। 'সব-কা সাথ সব-কা বিকাশ'-এর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার সার্বিক উন্নয়নের আদর্শ অনুসরণ করে চলছে। দেশের জনগণের উন্নয়ন এবং তাঁদের ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বিবিধ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে স্কিল-ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়া। প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনা, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা, বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও অভিযান, প্রধানমন্ত্রী উজ্বলা যোজনা, মেক-ইন-ইন্ডিয়া, দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা, মিশন ইন্দ্রধনুষ, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা, প্রধানমন্ত্রী কুশল বিকাশ যোজনা, সুগম্য ভারত অভিযান এবং আরও অনেক।

রাজ্যপাল বলেন, রাজ্যবাসী পরিবর্তনের পক্ষে জোরালো রায় দিয়েছেন এবং রাজ্য সরকার জনগণের স্বার্থে, বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের কল্যাণে সার্বিক দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করার জন্য প্রস্তুত। রাজ্যের বৃহত্তর অংশের মানুষ তাঁদের জীবন-জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। বর্তমান সরকার কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকদের কল্যাণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। উন্নত কৃষি-পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার কাজ করবে। তাছাড়া সরকার এ-ও সুনিশ্চিত করবে যে রাজ্যের রবার উৎপাদনকারীরা যাতে নায্যমূল্য পান এবং এই ব্যবস্থা থেকে সকল মধ্যস্বত্বভোগীদের সরিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, রাজ্যে বাঁশ ও রবার প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে রাজ্য সরকার। যা কৃষকদের অধিক আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং ত্রিপুরার অর্থনীতিতে দ্বিগুণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া রাজ্যে ক্যুইন ভ্যারাইটি আনারসের গুণগতমান বজায় রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যায়নের প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। সরকার জম্মুই পাহাড়ে কমলা চাষের উপর গবেষণা করে তা পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করতেও অঙ্গীকারবদ্ধ। রাজ্যে উৎপাদিত আনারস, কাঁঠাল, কমলা, লেবু প্রভৃতি ফল নিয়ে উন্নত প্রযুক্তির ফুড প্রসেসিং এবং প্যাকেজিং শিল্প গড়ে তোলার জন্যও বিশেষ জোর দেওয়া হবে। কৃষকদের উন্নয়ন ও ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কৃষির পরিপূরক বাঁশ ও রবার প্রক্রিয়াকরণের মতো ক্ষেত্রে আধুনিক শিল্প গড়ে তুলতে উৎসাহদানের জন্য একটি ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড স্থাপন করা হবে। কৃষকদের আকস্মিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি আমদানি বিমা যোজনা এবং প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা কার্যকরভাবে রূপায়ণ করা হবে।

রাজ্যপাল তথাগত রায় তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন, সরকার কৃষি, উদ্যান ও প্ল্যান্টেশন সেক্টরের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় পারম্পরিক জুম চাষের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার গঠন করারও প্রস্তাব রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে পশুপালন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পশুপালন, প্রাণী ও দুগ্ধ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রদানে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন, রাজ্যে প্রজনন উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ, প্রতি জেলায় দুগ্ধ সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন এবং পোল্ট্রি ও ডায়েরি ক্ষেত্রে সমবায় সংস্থা ও মহিলা আত্মসহায়ক দলগুলোকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে সরকার এই ক্ষেত্রকে উন্নত করার উদ্যোগ নেবে। রাজ্যে মৎস্যচাষ উন্নয়নের প্রতিও বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। আবদ্ধ জলাশয়ে মৎস্যচাষ পদ্ধতিতে অধিক মাত্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সমবায় সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, আত্মসহায়ক দল ও উদ্যোগীদের মাধ্যমে মৎস্যচাষে উৎসাহ প্রদান করা হবে। বাঁশ ও বেত রাজ্যের অর্থনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে এবং এর উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাঁশ চাষের বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়নের জন্য সরকার একটি ব্যাম্বু রিসার্চ ইন্সটিটিউট স্থাপন করার প্রস্তাব রেখেছে। সমবায় ভিত্তিতে ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকায় বাঁশ চাষ প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। বাঁশ ও বেতভিত্তিক কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প স্থাপনে উৎসাহদানের জন্য এবং বাঁশভিত্তিক শিল্পের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য রাজ্য সরকার একটি নীতি প্রণয়ন করবে।

তিনি বলেন, দরিদ্র উপজাতি জনগণ এবং সমাজের দুর্বলতর অংশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমাবায় প্রতিষ্ঠানসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমবায় ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে কো-অপারেটিভ ট্রেনিং ইন্সটিটিউটকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। তাছাড়া ত্রিপুরা রাজ্য সমবায় ব্যাংককেও আধুনিক ও শক্তিশালী করে তোলা হবে। রাজ্যের জনগণকে কর্মসংস্থান দেওয়ার লক্ষ্যে রাজ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প ইউনিটের পুনরুজ্জীবন, নতুন শিল্প স্থাপন, বিদেশি ও স্বদেশি বিনিয়োগকারীদের আনয়ন, তথ্য প্রযুক্তি শিল্প স্থাপনে উৎসাহদান, স্ব-উদ্যোগী শিল্প স্থাপনে সুবিধা দান ইত্যাদি বহুমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যেক পরিবারে অন্তত একটি কর্মসংস্থান প্রদানের জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। রাজ্যের কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রগুলিকে আরও উন্নত এবং ডিজিটাইজড করে তোলা হবে। বেকার ইঞ্জিনিয়ার ও স্নাতকোত্তর ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রিপ্রাপ্ত বেকারদের সরকারি কন্ট্রাক্ট নেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প চালু করারও প্রস্তাব রাখা হচ্ছে।

তিনি জানান, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সপ্তম বেতন কমিশনের সুবিধাদি প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সরকার রিকশা, অটো-রিকশা, টোটো বা ই-রিকশা চালক, কাঠশিল্পী, চর্মশিল্পী, ক্ষৌরকর্মী, মালবাহক শ্রমিক, সবজি ও ফল বিক্রেতা, ধাত্রী, গৃহপরিচারিকা প্রভৃতি কাজের সঙ্গে যুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও তাঁদের মানোন্নয়নের জন্য একটি বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করারও প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। চা-বাগিচা শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্ল্যান্টেশনস লেবার অ্যাক্ট ১৯৫১ সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগের প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। চা বাগিচা শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা ও অন্যান্য পরিকাঠামোগত সুবিধাদির সংস্থান, স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প রূপায়ণ এবং বাগিচা শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত জাতীয় ন্যূনতম মজুরি প্রদান সুনিশ্চিতকরণ প্রভৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। শিক্ষা পরিকাঠামোকে আরও প্রসারিত ও শক্তিশালী করে তোলা হবে।

রাজ্যপাল বলেন, সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীর ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও সুনিশ্চিত করা হবে। শিক্ষকদের জন্য যথোপযুক্ত বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুবিধাদি সুনিশ্চিত করা হবে। শিক্ষাকে বৃত্তিমুখী করে তোলার জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ঐচ্ছিক বৃত্তিমুখী বিষয় চালু করার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে পারম্পরিক দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ডিগ্রি/ডিপ্লোমা প্রদান করার জন্যও একটি ব্যবস্থা চালু করারও প্রস্তাব রয়েছে সরকারের।

কোন মন্তব্য নেই: