শহরে ফের বিপন্ন ঐতিহ্য, শুরু হয়েছে বিতর্ক - Aaj Bikel
শহরে ফের বিপন্ন ঐতিহ্য, শুরু হয়েছে বিতর্ক

শহরে ফের বিপন্ন ঐতিহ্য, শুরু হয়েছে বিতর্ক

Share This

 

কলকাতা: নিশ্চিহ্ণ হয় যাচ্ছে অতীত কলকাতার আর এক সাক্ষী। প্রতিবাদে সরব হলেন এ শহরের বিশিষ্ট স্থপতিও সুধীজনদের একাংশ। কলকাতা পুরসভার কাছে প্রশ্ন পেশ হচ্ছে তথ্য জানার অধিকার আইনে।


অতীতে কলকাতার ঐতিহ্যের অনেক ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। যেগুলির সঙ্গে জড়িত ছিল এ শহরের বেড়ে ওঠার নানা স্মৃতি ও কাহিনী। যেমন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল, লালদিঘির ধরে ডালহৌসি ক্লাব প্রভৃতি। ২০০৯-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্য তালিকা। এতে ‘গ্রেড থ্রি’ তালিতাভুক্ত ভবন শর্তসাপেক্ষে ভাঙার বিধান রয়েছে ১৯৯০ সালের কলকাতা পুর আইনে। ভাঙ্গার আগে, এই সব ভবনের সামনে অতীতের কথা ফলক বসিয়ে জানানোর কথা। এ ভাবে নিশ্চিহ্ণ হয়েছে অধুনা হরিশ মুখার্জি রোডের ধারে প্রবাদপ্রতীম সাংবাদিকের বাড়ি, পোলক স্ট্রিটে সোভিয়েত নাট্যকার গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফের ঐতিহ্যের মঞ্চ। বাংলায় যাত্রা শুরুর অধ্যায়ে ওই মঞ্চের বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

১৯৪৮ সালে এক খ্রিস্টান দম্পতির কাছ থেকে এক সম্পন্ন পার্সি দম্পতি কিনে নেন ৭, লিটল রাসেল স্ট্রিটের (অধুনা নন্দলাল বসু সরণি) বাড়িটি। মিডলটন স্ট্রিটের (অধুনা প্রফুল্ল চন্দ্র সেন সরণি) সংযোগস্থলে তৈরী হয় তিন তলা হোটেল। মালিক জয়েস পুর্দির নাম অনুসারে এটিকে বলা হয় ‘পুর্দি ম্যানসন’। বেশ কিছুকাল আগেই অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় হোটেল। এটি ভেঙে তৈরি হবে ৩৫ তলা বানিজ্যিক ভবন। ‘অ্যালকোভ রিয়েলিটি’ করছে মিডলটন স্ট্রিট ও লিটল রাসেল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে বহুতল নির্মানের কাজ। কলকাতায় সর্বোচ্চ নির্মীয়মান ভবন ৪২এ জওহরলাল নেহরু রোডের ৬৫ তলার ‘দি ফর্টিটু’ করছে প্রমোটরদের একটি কনসোর্টিয়াম। এর অন্যতম শরিক ‘অ্যালকোভ রিয়েলিটি’।

শুক্রবার অকুস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দু’টি রাস্তার লোহার ফটকের পাশেই ‘দি ফর্টিটু’-র বোর্ড। দেওয়ালের পাশে কাপড়ের উঁচু আচ্ছাদন দিয়ে ঢাকা। ভিতরে বাড়িটার মূল অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। রাস্তায় বাড়ির সামনের অংশে কিছু বেওয়ারিশ দোকান। এই বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ির সামনে ‘দি ফর্টিটু’-র পিছনের অংশ। ‘অ্যালকোভ রিয়েলিটি’-র চেয়ারম্যান অমরনাথ শ্রফের দাবি, এই প্রকল্পে কোনও অনিয়ম হচ্ছে না। ভবনটির মালিকানা আগেই তাঁদের হাতে ছিল। প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনার সময়ে যাতে আইনি সুরক্ষা নেওয়া যায় পুরসভা তাঁদের আগাম জানাতে বলেছিল। সে সবের পরেই পুরনো বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।

‘ক্যালকাটা আর্কিটেকচারাল লিগাসিস’ নামে একটি সংগঠন এর প্রতিবাদে সরব হয়েছে। দ্বিতীয় প্রাচীন হোটেল। প্রতিবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ঐতিহ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে পুরসভাকে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হল? ইংরেজি ভাষার নামী লেখক অমিত চৌধুরী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “দিস ইজ এগেনস্ট দি এথিকস অ্যান্ড নর্মস অফ হেরিটেজ কনসারভেশন ইট ল্যাকস পাবলিক অ্যাকাউন্টেবিলিটি। ইট রেইজেস কোশ্চেনস অ্যাবাউট দি ওয়ার্কিং অফ দি কমিটি।”

মিডলটন স্ট্রিট ও লিটল রাসেল স্ট্রিটের সংযোগস্থলের কেনিওয়ার্থ হোটেল কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্য তালিকায় ছিল ‘গ্রেড টু-এ’ পর্যায়ে। আইন বলছে, এ রকম ভবন ভাঙা যাবে না। অমরনাথ শ্রফের দাবি, ২০১৬-র অগস্ট- সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা বাড়িটিকে ঐতিহ্য তালিকার ‘গ্রেড টু-এ’ থেকে বাদ দিয়ে গ্রেড থ্রি-র অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করেন পুরসভার কাছে। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারি তা মঞ্জুর হয়। পরের মাসে পুরসভার মাসিক বৈঠকে ছাড়পত্র দিয়ে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশোনা করে যারা, মানে পিএমইউ (প্রজেক্ট মনিটরিং ইউনিট) বিভাগে। ছ’মাসের মধ্যে সেটি অনুমোদন পায়। এর পর বাড়ির নকশা মঞ্জুরের জন্য় আবেদন করা হয় ডিজি (বিল্ডিং)-এর কাছে।

পুরসভার ডিরেক্টর জেনারেল সুব্রত শিলের মতে, “সেভাবে অনন্য ঐতিহ্য বলতে যা বোঝায়, এই বাড়িতে তা ছিল না। ১৯৮০ সালের ৪২৫ (ও) ধারায় আছে, “এনি হেরিটেজ বিল্ডিং হ্যাজ সিসড টু বি অফ পাবলিক ইন্টারেস্ট অর হ্যাজ লস্ট ইটস ইমপরটেন্স ফর এনি রিজন হোয়াটসোএভার, ইট মে, উইথ দি অ্যাপ্রুভাল অফ দি স্টেট গভর্নমেন্ট, ডিক্লেয়ার দ্যাট সাচ হেরিটেজ বিল্ডিং হ্যাজ সিসড টু বি এ হেরিটেজ বিল্ডিং।”

‘কলকাতা আর্কিটেকচারাল ফাউন্ডেশন’ একটি আরটিআই পেশ করছে। সংগঠনের তরফে অবিন চৌধুরী বলেন, আমরা জানতে চাই, বাড়িটিকে ঐতিহ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে কমিটির ওই বৈঠকে কারা ছিলেন, কিসের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া হল?

রুশ অভিযাত্রী, ভাষাবিদ, অনুবাদক, সংগীতজ্ঞ, লেখক এবং ভারততত্ত্ব বিষয়ের পন্ডিত ছিলেন গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ (১৭৪৯ – জুলাই ২৭, ১৮১৭)। প্রথম বাংলা নাটকের রচয়িতা ও পরিচালক হিসাবে কলকাতায় ২৫ নম্বর ডোমটোলাতে "দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার" নামে একটি থিয়েটার গড়ে তোলেন। ‘দ্য ডিজগাইজ’- এর অনুবাদে প্রথম অনুদিত বাংলা নাটকটির নাম "সংবদল"। ১৭৯৫ সালের ২৭ শে নভেম্বর এটি প্রথম দেখানো হয়। সূত্রের খবর, ডোমটোলার মঞ্চটি সংরক্ষণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল রুশ প্রশাসন | সেই আবেদনও মান্যতা পায়নি। এটিকেও পুরসভার ঐতিহ্য তালিকায় গ্রেড থ্রি পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়।

১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে কলকাতার টাউন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা আয়োজিত হয়। এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ২৪৪ জন ছাত্র। ১৮৬২ সালে সেনেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরই ২,৫২,২২১ টাকা ব্যয়ে ঐতিহাসিক সেনেট হলটি তৈরী হয়। ১৮৭৩ সালের ১২ মার্চ হলের উদ্বোধন হয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অতীতে এই সেনেট হল ভেঙে শতবার্ষিকী হল তৈরির সময়ে প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই: