কলকাতা: দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ রাজ্যের জনবিন্যাসের ধারা ৷ ফলে অচিরেই দেখা দেবে বিপন্নতা ও সঙ্কট ৷ এই অভিযোগ তুলে অসমের মত পশ্চিমবঙ্গেও জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরির দাবি উঠল নাগরিকসমাজের তরফে ৷ শনিবার কলকাতায় এই কারণে ডাকা এক সম্মেলনে বিশিষ্ট কয়েকজন তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন৷
পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় জনবিন্যাসের ভারসাম্য আনতে, মৌলবাদী হিংসা ব্ন্ধ করতে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারূদের চিহ্নিতকরণ ও প্রত্যর্পণের প্রয়োজনে অসমের মত পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক পঞ্জী নবীকরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আহুত আলোচনা সভায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শুভদীপ রায়, গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী বিজন মহাজন, সমাজকর্মী ড: মোহিত রায়, সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত প্রমুখ। আমন্ত্রিত বক্তা গৌরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসের অনুপস্থিতিতে তাঁর সংশ্লিষ্ট পড়ে শোনানো হয়। ‘অসমের মতন পশ্চিমবঙ্গে এখনই প্রয়োজন নাগরিকপঞ্জী নবীকরণ’ শীর্ষক একটি পুস্তিকার আবরণ সভায় উন্মোচন করেন জাতীয় অধ্যাপক জয়ন্ত রায়৷
সূত্রের খবর, গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রথম খসড়া অসমের সর্বানন্দ সনোয়ালের বিজেপি সরকারের সহযোগিতায় রাজ্যবাসীর জন্য প্রকাশ করেন ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল (আরজিআই) এস শৈলেশ এবং এনআরসি-র রাজ্য কোঅর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা (আইএএস)। প্রকাশিত আংশিক খসড়ায় নাম রয়েছে ১.৯ কোটি মানুষের। অসমের মোট জনসংখ্যার মধ্যে নাগরিকপঞ্জির জন্য আবেদন করেছিলেন ৩.২৯ কোটি পরিবার। ২০১৩ সালে এর প্রক্রিয়া শুরু হলেও আক্ষরিক অর্থে কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের মে থেকে। মোট ৬৮.২৭ লক্ষ পরিবারের ৬.৫ কোটি নথি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মোট ৩৮ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ অসম হয়ে ভারতে ঢোকার কারণে ১৯৫১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু করে ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল।
এদিনের সভায় সুপ্রিম কোর্টের স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল শুভদীপ রায় বলেন, “১৯০১ সালের জনগননায় অসমে মোট জনসংখ্যার ১২.৪% ছিল মুসলমান৷ ২০১২-তে তা হয়েছে ৩৪.২২%. কেবল ১৯৭১ থেকে ’৯১- এই দুই দশকে অসমে হিন্দুর সংখ্যা বেড়েছে ৪৯.৮%, কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে ৭৭.৪২%. বাংলাদেশ থেকে অসমে এই ব্যাপক অনুপ্রবেশ রক্ষার চেষ্টায় নাগরিক পঞ্জী তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল বহু আগে৷ নানা কারণে তা বাধা পেয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে একটি জনস্বার্থের মামলার পর শীর্ষ আদালতের তদারকিতে এখন চলছে নাগরিকপঞ্জী তৈরির কাজ৷” তথ্য় সহকারে এর আইনি নানা দিক বিশদ ব্যাখ্যা করেন শুভদীপবাবু৷
নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রথম দাবি উঠেছিল আশির দশকের শেষদিকে ‘সারা অসম ছাত্র সংস্থা’ (আসু)-র তরফে৷ ওই দলের প্রাক্তন নেতা তথা আইনজীবী বিজন মহাজন বলেন, “অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের সিংহভাগে কাঁটাতার দিয়ে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়েছে৷ কিন্তু তার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ দীর্ঘ হওয়া সত্বেও পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তের সিংহভাগ এখনও উন্মুক্ত৷” রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, “কেউ কেউ রটানোর চেষ্টা করছেন, অসমে বাঙালি নিধনের চেষ্টা হচ্ছে৷ বাঙালি কে? এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার৷ কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার লোকেরাও ইংরেজিতে কথা বলেন৷ তাই বলে তাঁরা ইংরেজ নন৷ তেমনই বাংলায় কথা বললেই বাঙালি হওয়া যায় না৷ জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ খতিয়ে দেখুন, কিসের ভিত্তিতে দুই বাংলা ভাগ হয়েছিল! দোল-দুর্গোৎবের সংস্কৃতির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ৷ আরবি নয়, সংস্কৃত ছিল এর ভিত্তি৷”
মোহিত রায় বলেন, “১৯৪৭ সালে তারকেশ্বরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যে আন্দোলন করেন, তার ফলে আমরা পেয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গ৷ আজ আমরা যে আন্দোলনের বীজ এখানে পুঁতলাম, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী৷ ২০১১-র জনগননায় এ রাজ্যে মুসলমান ছিল ২৭ শতাংশ৷ এখন মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন, এটা হয়েছে ৩১.৯ শতাংশ৷ এখনই যদি এই বৃদ্ধি রোধে আমরা সক্রিয় না হই, চরম বিপদ আসতে বাধ্য৷”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন